বাংলাদেশে ডেঙ্গু জ্বরের (DENG-gey) প্রাদুর্ভাব বেশ কিছু বছর ধরে বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রথম দিকে শুধু ঢাকায় দেখা গেলেও বর্তমানে সারা দেশে এর প্রাদুর্ভাব রয়েছে। বাংলাদেশে সাধারণত, জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা যায়।
ডেঙ্গু জ্বরের মূল কারণ হল ডেঙ্গু ভাইরাসের (DENG-gey virus) সংক্রমণ। এই ভাইরাস এডিস মশার মাধ্যমে সহজভাবে ছড়ায় এবং মশার কামড়ের মাধ্যমে ভাইরাস সংক্রমণের তিন থেকে পনেরো দিনের মধ্যে সচরাচর ডেঙ্গু জ্বরের উপসর্গগুলো দেখা দেয়।
ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ [Symptoms of dengue fever ]
ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণগুলি সাধারণভাবে জ্বরের সাথে মিলে যায়। এই জ্বরের সাধারণ লক্ষণগুলি নিম্নলিখিত হতে পারে:
জ্বর: ডেঙ্গু জ্বরের প্রধান লক্ষণ হল জ্বর। জ্বর সাধারণত হঠাৎ করেই শুরু হয় এবং ৯৯ থেকে ১০৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত তাপমাত্রা উঠতে পারে। জ্বর টানা থাকতে পারে, আবার ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়ে দেওয়ার পর আবারও আসতে পারে।
শারীরিক দুর্বলতা: ডেঙ্গু জ্বরে রোগী সাধারণভাবে অত্যন্ত শারীরিক দুর্বলতা অনুভব করেন।
ব্যথা: ডেঙ্গু জ্বরে শরীরে ব্যথা, বিশেষ করে পেশী, জয়েন্ট এবং হাড়ে।
মাথা ব্যথা: কিছু সময় ডেঙ্গু জ্বরে মাথা ব্যথা অনুভব করা হতে পারে।
প্রতিরোধশক্তির ক্ষমতা হার: ডেঙ্গু জ্বরে প্রতিরোধশক্তির ক্ষমতা হার নিম্ন হতে পারে, যা অন্যান্য সমস্যার জন্য ভায়সি করে।
এছাড়া চোখের পিছনে ব্যথা, প্রচণ্ড পেট ব্যথা, অস্থিরতা বা খিটখিটে ভাব, বমি বমি ভাব বা বমি এবং চামড়ায় লালচে দাগ বা ফুসকুড়ি দেখা যেতে পারে।
গুরুতর ডেঙ্গু
ডেঙ্গু জ্বরের কয়েকটি লক্ষণ গুরুতর হতে পারে, যেমন:
- দ্রুত জ্বর বাড়া
- শরীরে প্রচুর ব্যথা
- প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যাওয়া
- রক্তচাপ কমে যাওয়া
- শ্বাসকষ্ট
- রক্তক্ষরণ
এই লক্ষণগুলি দেখা দিলে অবিলম্বে চিকিৎসা নেওয়া জরুরি।
ডেঙ্গু জ্বরের চিকিৎসা [Treatment of Dengue Fever]
ডেঙ্গু জ্বরের নির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা নেই। তবে, জ্বর কমাতে প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ সেবন করা যেতে পারে। কিন্তু কোনো ব্যক্তির যদি লিভার, হার্ট এবং কিডনি–সংক্রান্ত জটিলতা থাকে, তাহলে প্যারাসিটামল সেবনের আগে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
প্রচুর পরিমাণে তরল পান করা ও বিশ্রাম নেওয়া জরুরি। জ্বর এবং ব্যথা যদি নিয়ন্ত্রণে না আসে বা গুরুতর লক্ষণ দেখা দেয় তাহলে হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে।
ডেঙ্গু জ্বর কমে গেলে কি বিপদ কেটে গেল?
না, ডেঙ্গু জ্বর কমে গেলে বিপদ কেটে যায় না। ডেঙ্গু জ্বরের প্রাথমিক লক্ষণগুলি সাধারণত ২-৭ দিনের মধ্যে কমে যায়, তবে ভাইরাসটি শরীরে দীর্ঘদিন থাকতে পারে। তাই, ডেঙ্গু জ্বর কমে গেলেও কিছুদিন পর্যবেক্ষণ করা উচিত।
ডেঙ্গু জ্বরের গুরুতর জটিলতাগুলি সাধারণত জ্বর কমে যাওয়ার পরে ১-২ দিনের মধ্যে দেখা দেয়। এই জটিলতাগুলির মধ্যে রয়েছে:
- ডেঙ্গু শক সিনড্রোম (DSS): এটি রক্তচাপ কমে যাওয়া, রক্তক্ষরণ এবং অঙ্গের ক্ষতির কারণ হতে পারে।
- ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার (DHF): এটি রক্তক্ষরণ এবং অঙ্গের ক্ষতির কারণ হতে পারে।
এই জটিলতাগুলি খুব দ্রুত বিকাশ লাভ করতে পারে, তাই ডেঙ্গু জ্বর থেকে সেরে ওঠা ব্যক্তিদের ঘনিষ্ঠ পর্যবেক্ষণ করা উচিত।
ডেঙ্গু জ্বর থেকে সেরে ওঠার পরেও কিছুদিন পর্যন্ত শরীর দুর্বল থাকতে পারে। তাই, এই সময়টিতে অতিরিক্ত পরিশ্রম করা উচিত নয়।
ডেঙ্গু জ্বর হলে কি কি খাবেন [What to eat if you have dengue fever]
ডেঙ্গু জ্বর হলে নিম্নলিখিত খাবারগুলি খাওয়া উচিত:
- প্রচুর পরিমাণে তরল পান করা জরুরি। বিশেষ করে পানি, ডাবের পানি, ফলের রস, স্যুপ, ইত্যাদি। তরল পান করা ডেঙ্গু জ্বরের কারণে শরীরে যে পানিশূন্যতা দেখা দেয় তা পূরণ করতে সাহায্য করে।
- ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া উচিত। ভিটামিন সি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবারের মধ্যে রয়েছে কমলা, লেবু, আম, আনারস, আপেল, ব্রোকলি, ইত্যাদি।
- প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া উচিত। প্রোটিন শরীরের ক্ষতিগ্রস্ত কোষগুলি মেরামত করতে সাহায্য করে। প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবারের মধ্যে রয়েছে মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, ডাল, ইত্যাদি।
- ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া উচিত। ক্যালসিয়াম হাড় এবং দাঁতকে শক্তিশালী করতে সাহায্য করে। ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবারের মধ্যে রয়েছে দুধ, দই, চিজ, ব্রোকলি, ইত্যাদি।
- আয়রন সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া উচিত। আয়রন রক্তস্বল্পতা প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে। আয়রন সমৃদ্ধ খাবারের মধ্যে রয়েছে মাংস, মাছ, ডিম, ডাল, বাদাম, ইত্যাদি।
ডেঙ্গু জ্বর হলে নিম্নলিখিত খাবারগুলি এড়িয়ে চলা উচিত:
- অতিরিক্ত ভাজাপোড়া খাবার এড়িয়ে চলা উচিত।
- অতিরিক্ত মসলাযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলা উচিত।
- অতিরিক্ত মিষ্টি খাবার এড়িয়ে চলা উচিত।
- কোমল পানীয় এড়িয়ে চলা উচিত।
- অ্যালকোহল এড়িয়ে চলা উচিত।
ডেঙ্গু জ্বর হলে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী খাবার খাওয়া উচিত।
ডেঙ্গু জ্বর নিয়ে সাধারণ জিজ্ঞাসা [FAQ Dengue Fever]
ডেঙ্গু জ্বরে কি মৃত্যুর ঝুঁকি রয়েছে?
হ্যাঁ, ডেঙ্গু জ্বরে মৃত্যুর ঝুঁকি রয়েছে। ডেঙ্গু জ্বরে মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়ানোর কারণগুলির মধ্যে রয়েছে:
- বয়স: ডেঙ্গু জ্বরে শিশু এবং বয়স্কদের মৃত্যুর ঝুঁকি বেশি।
- অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যা: ডেঙ্গু জ্বরে ডায়াবেটিস, কিডনি রোগ, লিভার রোগ, ইত্যাদি রোগ থাকলে মৃত্যুর ঝুঁকি বেশি।
- গুরুতর লক্ষণ দেখা দেওয়া: জ্বর এবং ব্যথা কমে যাওয়ার পরে 1-2 দিনের মধ্যে ডেঙ্গু শক সিনড্রোম (DSS) বা ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার (DHF) দেখা দিলে মৃত্যুর ঝুঁকি বেশি।
সাধারণত মৃত্যুঝুঁকি তাদের ক্ষেত্রেই হয়ে থাকে যারা অবহেলা করে সময়মতো ডাক্তারের শরণাপন্ন হন না। তাই ডেঙ্গু নিয়ে অযথা ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই।
ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত মা বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়াতে পারবেন কি?
হ্যাঁ, ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত মা বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়াতে পারবেন। ডেঙ্গু ভাইরাস মায়ের বুকের দুধে পাওয়া যায় না। তাই ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত মায়ের বুকের দুধ খাওয়ালে শিশুর ডেঙ্গু হওয়ার ঝুঁকি থাকে না।
ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত মা বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ানো উচিত কারণ এটি শিশুর জন্য অনেক উপকারী। বুকের দুধ শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে। এছাড়াও, বুকের দুধ শিশুর শারীরিক এবং মানসিক বিকাশে সহায়তা করে।
তবে, ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত মায়ের কিছু বিষয় খেয়াল রাখা উচিত:
- মাকে অবশ্যই প্রচুর পরিমাণে তরল পান করতে হবে।
- মাকে অবশ্যই বিশ্রাম নিতে হবে।
- মাকে অবশ্যই জ্বর এবং ব্যথা কমাতে প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ সেবন করতে হবে।
- মাকে অবশ্যই ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণগুলি পর্যবেক্ষণ করতে হবে। যদি গুরুতর লক্ষণ দেখা দেয় তাহলে অবিলম্বে চিকিৎসা নেওয়া উচিত।
ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানো শিশুর জন্য নিরাপদ। তাই ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত মায়ের বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ানো উচিত।
এডিস ছাড়া অন্য কোনো মশার কামড়ে কি ডেঙ্গু ছড়ায়?
না, এডিস ছাড়া অন্য কোনো মশার কামড়ে ডেঙ্গু ছড়ায় না। ডেঙ্গু ভাইরাস শুধুমাত্র এডিস মশার মধ্যে সংক্রমণ করতে পারে। এডিস মশার মধ্যে ডেঙ্গু ভাইরাস সংক্রমিত হলে, সেই মশা অন্য কোনো ব্যক্তিকে কামড়ালে সেই ব্যক্তির ডেঙ্গু হতে পারে।
এডিস মশার মধ্যে চারটি প্রজাতি রয়েছে: এডিস অ্যাজিপ্টি, এডিস অ্যালবোপিক্টাস, এডিস ইরিথ্রোপিজিয়াস এবং এডিস হেমোফিলাস। এডিস অ্যাজিপ্টি হল সবচেয়ে সাধারণ ডেঙ্গুবাহী মশা। এটি সাধারণত শহর এবং শহরতলির এলাকায় পাওয়া যায়। এডিস অ্যালবোপিক্টাস সাধারণত গ্রামাঞ্চলে পাওয়া যায়। এডিস ইরিথ্রোপিজিয়াস এবং এডিস হেমোফিলাস ডেঙ্গুবাহী মশার বিরল প্রজাতি।
ডেঙ্গু জ্বরে রক্তের কি কি পরীক্ষা কখন করা উচিত?
ডেঙ্গু প্রতিরোধের জন্য নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলি নেওয়া যেতে পারে:
ডেঙ্গু প্রতিরোধের জন্য এডিস মশার কামড় থেকে বাঁচতে হবে। এডিস মশা জমে থাকা পানিতে জন্মায়। তাই ঘরের আশেপাশের টব, বালতি, ফুলের টব ইত্যাদি পরিষ্কার রাখা এবং পানি জমতে না দেওয়া উচিত।
ডেঙ্গু জ্বর সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা।
মশারি ব্যবহার: ডেঙ্গু মশা সাধারণত সকাল ৭টা থেকে সন্ধ্যা ৭টার মধ্যে কামড়ায়। তাই এই সময়টিতে ঘরের ভিতরে থাকলে মশারি ব্যবহার করা উচিত।
মশা প্রতিরোধক ক্রিম লাগানো: মশা প্রতিরোধক ক্রিম লাগানো মশার কামড় থেকে বাঁচতে সাহায্য করে।
পোশাক দিয়ে শরীর ঢেকে রাখা: পোশাক দিয়ে শরীর ঢেকে রাখলে মশার কামড় থেকে বাঁচা যায়।
ঘরের আশেপাশের জলাশয় পরিষ্কার করা: এডিস মশা জমে থাকা পানিতে জন্মায়। তাই ঘরের আশেপাশের টব, বালতি, ফুলের টব ইত্যাদি পরিষ্কার রাখা এবং পানি জমতে না দেওয়া উচিত।
ডেঙ্গু জ্বর সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা: ডেঙ্গু জ্বর সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করলে মানুষ ডেঙ্গু প্রতিরোধে সচেতন হবে এবং মশার কামড় থেকে বাঁচতে সতর্ক হবে।
এছাড়াও, ডেঙ্গু জ্বর হলে দ্রুত চিকিৎসা নেওয়া উচিত।
তথ্যসূত্রঃ
- https://www.cdc.gov/dengue/symptoms/index.html
- https://www.webmd.com/a-to-z-guides/dengue-fever-reference
- https://www.mayoclinic.org/diseases-conditions/dengue-fever/diagnosis-treatment/drc-20353084
- https://www.who.int/news-room/fact-sheets/detail/dengue-and-severe-dengue
- https://www.medicinenet.com/dengue_fever/article.htm
- https://www.medicalnewstoday.com/articles/179471
- https://my.clevelandclinic.org/health/diseases/17753-dengue-fever
- https://bn.wikipedia.org/wiki/%E0%A6%A1%E0%A7%87%E0%A6%99%E0%A7%8D%E0%A6%97%E0%A7%81_%E0%A6%9C%E0%A7%8D%E0%A6%AC%E0%A6%B0