বেশিরভাগ সময়, চুল ঝরে পড়ার কারন চুলের গ্রন্থিকোষের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত হয়। মাথার তৈলাক্ত ত্বক, ধূলাবালি এবং বিভিন্ন রকম হেয়ার প্রোডাক্ট মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে চুলের গ্রন্থিকোষ গুলো বন্ধ হয়ে যায়। আর এই বন্ধ গ্রন্থিকোষ গুলো মাথার ত্বকে জালা-পোড়া, চুলকানি, খুশকি এবং চুল পড়া বৃদ্ধি করে।
কারি পাতা নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্যগুলোর কারনে কার্যকরভাবে এই সমস্যাগুলোর সমাধান করতে পারেঃ
- কারি পাতাতে প্রচুর এ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে যা মাথার ত্বককে ময়েশ্চারাইজ করে চুলের মৃত কোষগ্রন্থি থেকে রেহাই পেতে সাহায্য করে।
- এরা প্রোটিন এবং বিটা-ক্যারোটিনের একটি ভালো উৎস, এর দুটিই চুল পড়া এবং পাতলা হওয়া প্রতিরোধ করে।
- এই পাতা গুলোতে প্রচুর এ্যামিনো এসিডও রয়েছে যা কোষগ্রন্থি গুলোকে মজবুত এবং স্বাস্থ্যকর হতে সাহায্য করে।
কারি পাতা ব্যবহার করার বিভিন্ন উপায়
কারি পাতা আপনি বিভিন্নভাবে ব্যবহার করতে পারবেন। যেমনঃ
চুলের বৃদ্ধির জন্য কারি পাতার ব্যবহার
সতর্কতা: কারি পাতার পেস্ট ব্যবহারে আপনার ত্বকে এলার্জি হতে পারে। তাই মাথার তালুতে দেওয়ার আগে সামান্য একটু ত্বকে লাগিয়ে পরীক্ষা করে নিন। কারি পাতার বীজ থাকে, কিন্তু সেগুলো খাবেন না কারন এগুলো বিষাক্ত।
১. হেয়ার টনিক হিসেবে
আপনার যা যা প্রয়োজন
- এক মুঠো সতেজ কারি পাতা
- ২-৩ টেবিল চামচ নারিকেল তেল
আপনার যা করতে হবে
- একটি প্যানে নারকেল তেল ঢালুন এবং কারি পাতা গুলো এর মধ্যে ঢেলে দিন।
- পাতার চারপাশ কালো না হওয়া পর্যন্ত নাঢ়তে থাকুন। প্যান থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকুন কারন যখন আপনি কারি পাতা ভাজবেন তখন প্যান থেকে তেল ফুটে এর ছিটা গায়ে আসার সম্ভবনা থাকে।
- চুলার আঁচ বন্ধ করুন এবং মিশ্রণটি ঠান্ডা হতে দিন।
- টনিকটি ঠান্ডা হয়ে গেলে তেল গুলো ছেঁকে নিন। আপনি এখন আপনার চুলে মিশ্রণটি লাগাতে পারবেন।
- তেল আঙ্গুলের অগ্রভাগে লাগিয়ে আপনার মাথার ত্বকে আস্তে আস্তে ম্যাসাজ করুন। আপনার চুলের গোঁড়া থেকে আগা পর্যন্ত ভালোভাবে লাগাবেন।
- ম্যাসাজের পর ১ ঘন্টা তেলটি মাথায় রাখুন এবং এক ঘন্টা পর শ্যাম্পু দিয়ে ধুয়ে ফেলুন।
এটা কেন কাজ করে
নারিকেল তেল তীক্ষ্ন গুণ সম্পন্ন চুলের তেল হিসেবে সকলের কাছে পরিচিত এবং এই তেল আপনার চুল পরিপুষ্ট এবং ময়েশ্চারাইজড রাখতে সাহায্য করে। আর যখন এই তেল কারি পাতার সকল পুষ্টিগুণ এবং এর ভিটামিন বি-৬ এর সাথে মিশে যায়, তখন এটি একটি মিশ্রণে পরিণত হয়ে চুলের গোঁড়া মজবুত করতে সাহায্য করে এবং চুলের ঝড়ে পরা প্রতিরোধ করে।
সপ্তাহে কতবার ব্যবহার করা উচিত
এক মাসের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দেখতে সপ্তাহে ২-৩ বার আপনার মাথার ত্বকে ম্যাসাজ করুন এবং প্রতিবার লাগানোর পর চুল ধুয়ে ফেলুন। প্রতিদিন মাথার তালুতে তেল লাগালে এবং ম্যাসাজ করলে এটি আপনার চুল বৃদ্ধি করতে সাহায্য করবে।
২. চুলের মাস্ক হিসেবে
আপনার যা যা প্রয়োজন
- এক মুঠো কারি পাতা
- ৩-৪ টেবিল চামচ দই
আপনাকে যা করতে হবে
- কারি পাতাগুলো ব্লেন্ডারে দিয়ে মিশিয়ে নিয়ে একটি পেস্ট তৈরি করুন।
- ৩-৪ টেবিল চামচ দইয়ের সাথে ১ টেবিল চামচ কারি পেস্ট যোগ করুন। (দই এবং কারি পাতার পেস্টের পরিমাণ নির্ভর করে আপনার চুল কতটুকু লম্বা তার উপর)
- এই দুইটি উপকরণ ভালোভাবে মিশিয়ে নিয়ে পেস্ট তৈরি করুন।
- এই হেয়ার মাস্কটি দিয়ে আপনার মাথার তালু এবং চুল ম্যাসাজ করুন। এই পেস্টটি দিয়ে আপনার চুলের আগা থেকে গোঁড়া পর্যন্ত ঢেকে দিন।
- ৩০ মিনিট মাথায় রেখে দিন এবং শ্যাম্পু দিয়ে ধুয়ে ফেলুন।
- আপনি চাইলে দইয়ের বিকল্প হিসেবে ২ টেবিল চামচ দুধ মিশাতে পারেন।
এটা কেন কাজ করে
দই মাথার ত্বকে একটি খুব ভালো হাইড্রেটিং ক্লিনজার হিসেবে কাজ করে। এটি মৃত কোষ ও খুশকি দূর করে এবং আপনার মাথার ত্বক এবং চুল অনেক নরম এবং সতেজ করে। এতে অপরিহার্য পুষ্টিগুণ রয়েছে যা কোষল্গ্রন্থির উন্নয়ন করে মাথার তালুকে দূষনমুক্ত করতে সাহায্য করে। দই মিশানোর ফলে এই মিশ্রণটি অকালে পেঁকে যাওয়া প্রতিরোধ করে।
সপ্তাহে কতবার ব্যবহার করা উচিত
আপনার মাথার ত্বক সুস্থ রাখতে সপ্তাহে ওকবার এই মাস্কটি ব্যবহার করুন এবং আপনার চুল কোমল এবং উজ্জ্বল করে তুলুন।
৩. আপনার খদ্যে যোগ করুন
চুলের যত্নের মানে হলো আপনি আপনার শরীর যে খাদ্য গ্রহণ করবে তাই আপনার চুলও গ্রহণ করবে। চুল ঝরে পড়া প্রতিরোধ করতে এবং চুলের বৃদ্ধি জন্য একটি আদর্শ উপায় হলো আপনার খাদ্যে কারি পাতা যোগ করুন। আপনি কারি পাতার পাউডার বানিয়ে ভাত অথবা তরকারির সাথে খুব সহজেই মিশিয়ে খেতে পারবেন।
এছাড়াও আপনি কুচি কুচি করা পুদিনা পাতা এবং কারী পাতার মিশ্রণের সাথে দুধ অথবা বাটারমিল্ক মিশিয়ে খেতে পারেন।
কারিপাতা একটি সুন্দর গন্ধ আছে যা খিদে বাড়ানোর উপাদান বা এপেটাইজার (appetizer) হিসেবে কাজ করে। কিছু কারিপাতা ভেজে নিয়ে তার মধ্যে সেদ্ধ করা সবজি মিশিয়ে নিলে আপনার রোজকার একঘেয়ে খাবারে একটি সুন্দর গন্ধ যোগ হয় এবং একইসাথে এটি আপনার চুলের উপকারেও আসে।
চুলে কারি পাতা ব্যবহারের উপকারিতা
- কারি পাতা মৃত কোষ, ধূলাবালি এবং চিটচিটে ভাব দূর করে চুলের কোষগ্রন্থির উন্নতি করে। এদের মধ্যে প্রচুর পুষ্টিগুণ আছে যা চুলের গোঁড়া শক্ত করে এবং চুল পরা প্রতিরোধ করে।
- বিভিন্ন রকম হেয়ার প্রোডাক্টের ব্যবহারও মাথার ত্বকের জ্বালা-পোড়ার অনেক বড় বড় কারণগুলোর মধ্যে একটি। আপনার হেয়ার প্রোডাক্ট গুলো আপনার মাথার বহিঃত্বকের ঠিক নিচে জমা হতে পারে, যা আপনার চুলকে অনুজ্জ্বল এবং নিস্তেজ করে দেয়। এই সব প্রোডাক্টের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার আপনার চুলকে রুক্ষ করে দেয় যার ফলে আপনার চুলে জট বাঁধে এবং চুল ভেঙ্গে যায়। কারি পাতা চুলের বহিঃত্বকের ভিতর প্রোডাক্টের জমে থাকা প্রতিরোধ করে আপনার মাথার ত্বক এবং চুল সতেজ ও স্বাস্থ্যকর করে তুলে।
- কারি পাতা ভিটামিন-বি এর খুব ভাল একটি উৎস, চুলের স্বাস্থ্যের জন্য এটি একটি অপরিহার্য ভিটামিন। ভিটামিন-বি এর অভাবে চুল পড়া বৃদ্ধি পায়। কিন্তু কারি পাতা নতুন চুল জন্মাতে সাহায্য করে এবং আপনার চুল স্বাস্থ্যকর ও মজবুত করে তুলে।
- বয়স বাড়ার সাথে সাথে আপনার চুলও প্রাণহীন এবং দুর্বল হয়ে যাওয়া শুরু করে। একবার যদি আপনার মাথার কোষগ্রন্থির রঞ্জক পদার্থ নিঃশেষ হয়ে যায়, আপনার চুল সাদা হয়ে যাওয়া শুরু করে। কখনও কখনও তরুণদের চুলও পেঁকে যেতে পারে এবং তাদের চুল পাকার কারন গুলো হলো মাত্রারিক্ত চাপ নেওয়া, ধূমপান করা, বংশগত কারণ অথবা মাত্রাতিরিক্ত অ্যালকোহল পান করা ইত্যাদি। কারি পাতাতে উপস্থিত ভিটামিন-বি চুলের অকালে পেঁকে যাওয়া প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে এবং যার ফলে আপনার চুল নিজের রঙ ধরে রাখতে পারে এবং চুল দীর্ঘকাল উজ্জ্বল থাকে।
- কারি পাতাতে প্রচুর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে। অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট চুলের এবং মাথার ত্বকের স্বাস্থ্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। এটি আপনার চুলকে স্বাস্থ্যবান রাখতে ক্ষতিকারক র্যাডিকালের সাথে যুদ্ধ করে।
- কারি পাতা আপনার চুলের স্থিতিস্থাপকতা এবং বৃদ্ধি শক্তির উন্নতি করে। যখন ক্ষতিগ্রস্থ চুল যথেষ্ট পরিমাণ পুষ্টি এবং ময়েশ্চার পায়, তখন চুল তার পূর্ববর্তী শক্তি এবং দীপ্তি পুনরায় ফিরে পেতে শুরু করে। নারিকেল তেলের সাথে মিশ্রিত কারি পাতা, আপনার চুলকে সুস্থ করার জন্য প্রয়োজনীয় হাইড্রেশন এবং পুষ্টি প্রদান করতে সাহায্য করে।
- কারি পাতাতে উপস্থিত ভিটামিন-বি৬ হরমোনের নিয়ন্ত্রক হিসেবে কাজ করে যা আপনার চুলের গোঁড়া মজবুত করে চুলের পূর্ণাঙ্গ স্বাস্থ্যের উন্নতি করে।
চুল ঝরে পড়ার সাথে যুদ্ধ করা কঠিন কাজ মনে হতে পারে, অনেক সময় অসম্ভবও মনে হতে পারে। কিন্তু, আপনাকে যা করতে হবে তা হলো সঠিক সমাধান বের করে এর বিরুদ্ধে রুখে দাড়াতে হবে। প্রতিদিন রুটিন করে নির্দিষ্ট কিছু প্রাকৃতিক উপাদান যেমন কারি পাতা দিয়ে আপনার চুলের যত্ন নিতে হবে যা আপনার চুলের হারিয়ে যাওয়া মহিমা এবং উজ্জলতা পূনরুদ্ধার করবে।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.