
কোকো বাটারের কথা বললে আপনার কি চকলেট বার এবং চকলেট আইস্ক্রিমের কথা মনে পড়ে?
তাহলে আপনার অবশ্যই জানা দরকার এই উপকরণটি ত্বকের ক্রিম এবং সৌন্দর্য বৃদ্ধির পণ্যেও ব্যবহার করা হচ্ছে।
কোকো বাটার খেলে আপনার হয়ত ক্যালোরি অনেক গুণ বেড়ে যেতে পারে, কিন্তু আপনি যদি এটি আপনার ত্বকে ব্যবহার করেন তাহলে কোনো মতেই এটি আপনার ক্যালোরি বৃদ্ধি করবে না!
আপনি কেনো কোকো বাটার আপনার ত্বকে ব্যবহার করবেন?
কিভাবে এই বাটার কাজ করে?
এই প্রশ্নগুলোর উত্তর জানতে হলে আরো পড়তে থাকুন।
কোকো বাটার কি?
কোকো বাটার হলো এক ধরণের ফ্যাট বা চর্বি যা কোকো বীজ থেকে নেওয়া হয়। এই চর্বি মিষ্টান্ন এবং প্রসাধনী সামগ্রী উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়। প্রথমে বীজগুলি বৃহত্তর কোকো বীজ থেকে নেওয়া হয়, যেখানে এগুলো রোস্ট করা, ফালি করা এবং এরপর চেপে গুড়ো করা হয়। এরপর আলাদা করা ফ্যাটগুলি থেকে কোকো বাটার তৈরি করা হয়।
৩০০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে কোকো ঔষধ হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে। অ্যাজটেকস এবং মায়ানরা কোকো বীজকে মুদ্রা হিসেবে ব্যবহার করত। সাম্প্রতিক সময়ে, গবেষণা কোকোতে বায়োঅ্যাক্টিভ যৌগ এবং ত্বকের স্বাস্থ্যের জন্য এদের কার্যকারিতা আবিষ্কার করেছে। কোকো বাটারের বিভিন্ন ফ্যাটি এসিডের সংমিশ্রণ রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে:
- অলিক এসিড, ৩৪.৫%
- স্টেয়ারিক এসিড, ৩৪.৫%
- পামিটিক এসিড, ২৬.০%
- লিনোলিয়িক এসিড, ৩.২%
নারকেল তেলের মতই কোকো বাটারের বেশিরভাগ স্যাচুরেটেড ফ্যাট, যা সম্পূর্ণ বাটারের ৫৭ থেকে ৬৪ শতাংশ বাটার তৈরি করে। কোকো বাটার স্বাস্থ্যের জন্য কতটা ভালো তা না হয় অন্য কোনদিন আলোচনা করবো, কিন্তু এখন আমরা জানবো কোকো বাটার আপনার ত্বকে কি বিষ্ময় সৃষ্টি করতে পারে।
আপনার ত্বকে কোকো বাটারের উপকারিতা
১. বার্ধক্যজনিত লক্ষণগুলি হ্রাস করতে সহায়তা করে

অনেক বেশি ফ্যাট থাকার কারণে কোকো বাটার অন্যান্য ময়েশ্চারাইজারের চেয়ে অনেক বেশি গাঢ় এবং ঘন হয়। এটি আপনার শরীরের তাপমাত্রায় গলে যায়, তাই এটি আপনার ত্বক খুব সহজেই শোষন করে নেয় এবং ত্বককে ময়েশ্চারাইজড করতে সহায়তা করে। তাই, এটি ত্বকের শুষ্কতা প্রতিরোধ করে এবং আপনার ত্বককে নরম ও যৌবনদীপ্ত করে তুলে।
কোকোতে পলিফেনল রয়েছে যা বার্ধক্যজনিত লক্ষণগুলি হ্রাস করতে সহায়তা করতে পারে। পলিফেনল ত্বকের সংবেদনশীলতা এবং অবক্ষয় প্রতিরোধে সহায়তা করে। ত্বকের স্থিতিস্থাপকতার উপর কোকো পলিফেনলসের প্রভাব বাণিজ্যিক পণ্যগুলোর চেয়ে তুলনামূলকভাবে বেশি ভালো। কোকো কোলাজেন উৎপাদনে আর ভালো সাহায্য করতে পারে। এর ফলে দ্রুত বলিরেখা এবং ফাইন লাইনসের আসা প্রতিরোধ করে।
২. আন্ডার-আই ক্রিম হিসাবে কাজ করে
আমরা জানি যে কোকো বাটার ত্বকের স্থিতিস্থাপকতা আরো উন্নত করে। কোকোর এই বৈশিষ্ট্যটি বিশেষ করে চোখের নিচের ত্বকে ভালো কাজ করে, কারণ চোখের নিচের এই অংশে খুব দ্রুত বলিরেখা এবং ফাইন লাইনস দেখা যায়। বাটার চোখের চারদিকের এবং নিচের ত্বক টান তান করতে সহায়তা করে।
কোকো বাটার চোখের নিচের কালো দাগ দূর করতেও সাহায্য করে। এর ময়েশ্চারাইজিং বৈশিষ্ট্য চোখের নিচের কালো দাগ হালকা করতে সহায়তা করে।
৩. ফেঁটে যাওয়া ঠোঁট নিরাময়ে সহায়তা করে

কোকো বাটার উপশমকারী হিসেবে কাজ করে, যেমন এটি আপনার ঠোঁটে হাইড্রেশনের একটি প্রতিরক্ষামূলক স্তর যুক্ত করে। যা আপনার ঠোঁটের শুকিয়ে যাওয়া অথবা ফেঁটে যাওয়া থেকে রক্ষা করে। বাটার যেহেতু খাওয়া যায়, তাই এর বিষক্রিয়া নিয়ে চিন্তা করার কোন দরকার নেই।
কোকো বাটার ব্যবহার করে ঠোঁট আদ্র এবং হাইড্রেটেড রাখার মাধ্যমে মুখের ঘা হওয়া প্রতিরোধ করা যায়।
নির্ভরযোগ্য সূত্রের ভিত্তিতে, এই সকল উপায়েই কোকো বাটার আপনার ত্বকের উপকার করতে পারে।
আরেকটি অজানা সূত্র বলছে কোকো বাটার আপনার ত্বকে আরো বিভিন্ন রকম উপকার করতে পারে। এর মধ্যে রয়েছেঃ
- স্ট্রেচ মার্কস হ্রাস করা
কোকো বাটার ত্বককে ময়েশ্চারাইজ করে। এটি ত্বকের স্থিতিস্থাপকতা উন্নত করতে পারে এবং স্ট্রেচ মার্কসের উপস্থিতি হ্রাস করে।
- একজিমা এবং ত্বকের অন্যান্য অ্যালার্জির চিকিৎসায় সহায়তা করা
বাটারে থাকা ভিটামিন ই সহায়তা করতে পারে। অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট ভিটামিন অ্যালার্জি সৃষ্টিকারী জীবাণুগুলির বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারে এবং এই অবস্থার চিকিৎসায় কাজ করতে পারে। এটি আক্রান্ত ত্বককে নরম ও কোমলও করতে পারে।
- উল্কির ক্ষত চিকিৎসা করতে পারে
এই বাটারের ময়েশ্চারাইজিং বৈশিষ্ট্য উল্কির ক্ষত নিরাময়ে সহায়তা করতে পারে। তবে আমরা আপনাকে সতর্ক থাকার জন্যই কিছু পরামর্শ দিচ্ছি।
কোকো বাটার উপরোক্ত সুবিধাগুলি প্রদান করতে পারে তা নিয়ে সঠিক কোনো প্রমাণ নেই। তাই, আপনি এই উদ্দেশ্যে ব্যবহার করার আগে আপনার চর্ম বিশেষজ্ঞের সাথে পরামর্শ করে নিতে ভুলবেন না।
যদিও, কোকো বাটার ব্যবহার করার আরো কয়েকটি উপায় রয়েছে।
আর যে সকল উপায়ে আপনি কোকো বাটার ব্যবহার করতে পারেন
১. জ্বালা-পোড়া উপশম করতে
এর জন্য আপনাকে অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে কোকো বাটার খাঁটি কিনা। এতে কোনো অ্যালকোহল অথবা সুগন্ধী অথবা অন্য কোনো জিনিষ থাকা যাবে না।
আক্রান্ত স্থানে আস্তে আস্তে বাটার লাগান এতে পোড়া স্থানে আরামদায়ক অনুভূতি হবে। কিন্তু এটি কখনোই মূল চিকিৎসার প্রতিস্থাপন হিসেবে নেওয়া যাবে না। অর্থাৎ জ্বালা-পোড়ার মূল চিকিৎসা আপনাকে অবশ্যই করে নিতে হবে।
২. শেভিং ক্রিম হিসেবে
শেইভ করার জন্য এবং ত্বক হাইড্রেটেড রাখার জন্য আপনি কোকো বাটার ব্যবহার করতে পারেন। মুষ্টিমেয় বাটার নিলেই হবে। আপনি চাইলে গোসল করার পরেও এটি ব্যবহার করতে পারেন কারণ পানির তাপে আপনার ত্বকের পোরসগুলি খুলে যায় এবং তখন ত্বকে যেকোন পণ্য আরো ভালোভাবে শোষিত হয়।
আপনি দেখতেই পাচ্ছেন কিভাবে কোকো বাটার আপনার ত্বকের স্বাস্থ্যের উন্নতি করতে পারে।
আসুন আমরা কোকো বাটারে কি কি পুষ্টিগুণ রয়েছে তা একবার দেখে নেই। এই সকল পুষ্টিগুণ কোকো বাটারকে আমাদের ত্বকের জন্য বন্ধুসুলভ করে তুলেছে।
কোকো মাখনের পুষ্টিগুণ বিষয়ক তালিকা
ক্যালোরি তথ্য | ||
নির্বাচিত ঊপাদানের পরিমাণ | ডিভি% | |
ক্যালোরি | ১৯২৭ (৮০৬৮ কেজি) | ৯৬% |
কার্বোহাইড্রেট থেকে | ০.০ (০.০ কেজি) | |
ফ্যাট থেকে | ১৯২৭ (৮০৬৮ কেজি) | |
প্রোটিন থেকে | ০.০ (০.০ কেজি) | |
অ্যালকোহল থেকে | ০.০ (০.০ কেজি) | |
ফ্যাট এবং ফ্যাটি এসিড | ||
নির্বাচিত ঊপাদানের পরিমাণ | ডিভি% | |
মোট ফ্যাট | ২১৮ গ্রাম | ৩৩৫% |
স্যাচুরেটেড ফ্যাট | ১৩০ গ্রাম | ৬৫১% |
মোনোস্যাচুরেটেড ফ্যাট | ৭১.৭ গ্রাম | |
পলিঅনস্যাচুরেটেড ফ্যাট | ৬.৫ গ্রাম | |
মোট ট্রান্স ফ্যাটি এসিড | ~ | |
মোট ট্রান্স-মনোয়েনিক ফ্যাটি এসিড | ~ | |
মোট ট্রান্স-পলিয়েনিক ফ্যাটি এসিড | ~ | |
মোট ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড | ২১৮ মিলিগ্রাম | |
মোট ওমেগা-৬ ফ্যাটি এসিড | ৬১০৪ মিলিগ্রাম | |
ভিটামিন | ||
নির্বাচিত ঊপাদানের পরিমাণ | ডিভি% | |
ভিটামিন ই (আলফা টোকোফেরল) | ৩.৯ মিলিগ্রাম | ২০% |
ভিটামিন কে | ৫৩.৯ মিলিগ্রাম | ৬৭% |
আপনি কি জানেন? আপনি চাইলে বাড়িতেই কোকো বাটার তৈরি করতে পারেন। আর এর জন্য আপনার কিছু উপকরণ লাগবে। কোকো বাটার কিভাবে ঘরেই তৈরি করতে পারবেন তা নিচে দেওয়া হলোঃ
ঘরে বসে কিভাবে কোকো বাটার তৈরি করবেন
কোকো বাটার বানাতে আপনার যা যা লাগবে
- কোকো বীনস, যা
অবশ্যই
লাগবে - ঠান্ডা পানি
- একটি ওভেন, রোস্ট
করার
জন্য - পাখা বা ফ্যান
- হাতুড়ি বা হ্যামার
- চালনী
- বাটি
- কফি গ্রাইন্ডার
- পরিষ্কার কাপড়
কোকো বাটার বানানোর দিকনির্দেশনা
- পরিষ্কার ঠান্ডা পানি দিয়ে কোকো বীনগুলো ধুয়ে নিন। এটি অবাঞ্ছিত অবশিষ্টাংশ অপসারণ করবে। পরিষ্কার করার পর প্রাকৃতিক বাতাসে শুকিয়ে নিন।
- বীনগুলো ১০০ থেকে ১৩৫ ডিগ্রী ফারেনহাইটে ৯০ মিনিট রোস্ট করে নিন। খেয়াল রাখবেন যাতে প্রতিটি বীনে সমানভাবে তাপ প্রয়োগ হয়।
- ফ্যানের নিচে রেখে বীনসগুলি শুকিয়ে নিন। পুড়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করতে এটি দ্রুত করুন।
- বাইরের খোলস থেকে ভিতরের নিব বের করে আনতে হ্যামার দিয়ে আলতো করে প্রতিটি বীনে আঘাত করুন। বাহিরের খোলসটি রোস্ট করার কারণে আলতো হয়ে থাকে, তাই জোরে আঘাত করার প্রয়োজন হয় না।
- ভাঙ্গা কোকো বীনসগুলো চালনীতে নিন এবং চালনীর নিচে একটি বাটি রাখুন। আলতো করে চালনীতে রাখা নিবগুলো ঝাকাতে থাকুন। এতে করে সম্পূর্ণ গুঁড়ো হয়ে যাওয়া নিবগুলো নিচে রাখা বাটিতে পরবে। খোলসগুলো চালনীতেই রয়ে যাবে কারণ এগুলো চালনী দিয়ে নিচে পরার জন্য অনেক বেশি বড়।
- কোকো নিবগুলো কফি গ্রাইন্ডারে দিয়ে ভালোভাবে গুঁড়ো করে নিন। গ্রান্ডারের তাপ নিবগুলোর ফ্যাট গলিয়ে ফেলবে। এতে গুঁড়ো নিবগুলো তরলে পরিণত হয়ে যাবে।
- এখন আপনি সুতি কাপড়ের মধ্যে দিয়ে এই তরল ছেঁকে নিতে পারেন। এভাবেই আপনি কোকো বাটার ফিল্টার করে ফেলেছেন। এবং এভাবেই আপনার কাঙ্ক্ষিত কোকো বাটার পেয়ে গেছেন।
এখন আপনি জানেন কিভাবে ঘরেই কোকো বাটার তৈরি করা যায়। কিন্তু আপনি কোকো বাটার বানানো এবং ব্যবহার করার আগে আপনাকে অবশ্যই একটা বিষয় খেয়াল রাখতে হবে। তা হলোঃ
কোকো বাটার ত্বকের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। কেউ কেউ অনাকাঙ্ক্ষিত প্রতিক্রিয়ার মুখোমুখি হতে পারে। সুতরাং, ব্যবহার করার আগে অবশ্যই একটি প্যাচ টেস্ট করে নিবেন। আর তখন আপনি যদি আপনার ত্বকে অ্যালার্জির প্রতিক্রিয়া অনুভব করেন সাথে সাথেই এর ব্যবহার বন্ধ করে দিন এবং আপনার ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করুন।
কোকো বাটার আপনার ত্বকের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য একটি প্রাকৃতিক উপায়। এটি আপনার ত্বককে করে তুলে নরম, কোমল এবং স্বাস্থ্যজ্জোল। তাছাড়া, কোকো বাটার মুখের বলিরেখা ও ফাইন লাইন্স দূর করে আপনার ত্বককে করে তুলে যৌবনদীপ্ত এবং প্রাণবন্ত।
এছাড়া শীতকালে কোকো বাটার আপনার ফাঁটা ঠোঁট এবং ত্বকের সুরক্ষার জন্য হয়ে উঠে প্রকৃত বন্ধু। এছাড়া বাজারের বেশিরভাগ ত্বকের যত্নের পণ্য যখন কোকো বাটার প্রাথমিক উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে, তখন ঘরেই এই বাটার প্রস্তুত করে ব্যবহার করাটা আপনার নেওয়া সবচেয়ে সেরা সিদ্ধান্তগুলোর মধ্যে একটি হবে।